Latest News
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ই বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Home / শিল্প ও সাহিত্য / কবি জীবনানন্দের জন্ম কোথায়?

কবি জীবনানন্দের জন্ম কোথায়?

আমীন আল রশীদ

জীবনানন্দ দাশের জন্ম বরিশাল শহরে––এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং জীবনানন্দের জীবনীকারগণ এটিকেই সত্য বলে মানেন; এমনকি তার ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশের লেখায়ও বিষয়টি স্পষ্ট যে, ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জীবনানন্দ দাশ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার চেয়ে বড় কথা, জীবনানন্দ নিজেই একটি চিঠিতে লিখেছেন যে তার জন্ম বরিশালে। কিন্তু ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো এবং আরেকটি পুরনো পত্রিকা ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছে, জীবনানন্দের জন্ম ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামে।

 

জীবনানন্দের জন্মস্থান নিয়ে এই বিভ্রান্তি নতুন কিছু নয়। কেননা জীবনানন্দ মৃত্যুর পরে শঙ্খচিল শালিখের বেশে ধানসিঁড়িটির তীরে ফিরে আসতে চেয়েছেন এবং তাঁর কবিতায় অনেকবারই ঝালকাঠি শহরের অদূরে বয়ে চলা ধানসিঁড়ি নামের একটি সরু খালের উল্লেখ আছে বলে অনেকে এটি ভাবতে পছন্দ করেন যে, জীবনানন্দের জন্ম এই ধানসিঁড়ির পাড়ে কোনো এক গ্রামে। এ নিয়ে অনেকে আজগুবি সব গল্পও ফেঁদেছেন এবং দুঃখের বিষয় হলো এইসব গল্প দেশের প্রথিতযশা সংবাদপত্রে এর আগেও ছাপা হয়েছে। কিন্তু কেউ জোরালো প্রতিবাদ করেছেন বলে মনে হয় না। মূলত সে কারণেই এই নিবন্ধটি লেখা।

অনেকেই এটি বলার চেষ্টা করেন যে, জীবনানন্দ বরিশাল শহরে নয় বরং জন্মগ্রহণ করেছেন তার পাশের জেলা ঝালকাঠির ধানসিঁড়ি নদীর অদূরে বামনকাঠি গ্রামে এবং এক বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে বরিশাল শহরে গিয়ে স্থায়ী হন।

জীবনানন্দের কবিতায় বহুবার এই নদীর নাম এসেছে। যেমন-‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়’ অথবা ‘ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে/ ধানসিড়ি বেয়ে বেয়ে/ সোনার সিড়ির মতো ধানে আর ধানে ধানে/ তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে’ কিংবা   ‘ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম পউশের রাতে/ কোনোদিন আর জাগব না জেনে/ কোনোদিন জাগব না আমি- কোনোদিন জাগব না আর’…ইত্যাদি।

ধানসিড়ি নদীটি পঞ্চম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী গাবখান সেতুর উপর দিয়ে ভাটার সময় দেখা যায়। ঝালকাঠির সুগন্ধা-বিষখালি নদীর মোহনা থেকে উত্তর দিকে বয়ে গেছে গাবখান চ্যানেল। চ্যানেলে প্রবেশের পরপরই হাতের বাঁ দিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে সরু যে খালটি চলে গেছে রাজাপুর উপজেলার জাঙ্গালিয়া নদী পর্যন্ত, সেটিই ধানসিড়ি। দৈর্ঘ্য প্রায় ৮ কিলোমিটার। এটিকে নদী বলার সুযোগ নেই। বরং এটি একটি খাল এবং এর কোনো কোনো অংশ এখন মৃতপ্রায়।

কেউ কেউ ধারণা করেন, এ নদীতীরের কোথাও জীবনানন্দের এক আত্মীয়ের বাড়ি ছিল এবং তিনি সেখানে মাঝে মধ্যে আসতেন। কিন্তু সে বাড়িটি আসলে কোন্ জায়গায় ছিল এবং আত্মীয় কে––তা এখন আর কেউই বলতে পারেন না। স্থানীয়দের কেউ  কেউ দাবি করেন, ধানসিঁড়ি নদীর অদূরে বামনকাঠি গ্রামেই জীবনানন্দের জন্ম। যদিও এই দাবির সপক্ষে খুব জোরালো কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই।

ঝালকাঠির সাহিত্য সংগঠন কবিতাচক্রের প্রকাশনা ‘সরণি’র ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সংখ্যায় সোহরাব হোসেন নামে স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষক‘ধানসিঁড়ি নদী ও জীবনানন্দ দাশ’ শিরোনামে একটি লেখায় দাবি করেছেন, রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানসিঁড়ি পাশের গ্রাম বামনকাঠির দাস পরিবারে। তার প্রপিতামহ মহেন্দ্র কুমার দাশগুপ্তর বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরের গাউপাড়া গ্রামে। পদ্মার ভাঙনে তার ছোট তালুকটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে আর্থিক সংকটে পড়েন তিনি। মৃত্যুর পর তিনি তার তিন পুত্র সর্বানন্দ, নিত্যানন্দ ও প্রেমানন্দ দাশগুপ্ত পানসি করে ভাটির উদ্দেশে পাড়ি জমান।

এই লেখায় স্পষ্টতই তিনটি ভুল দেখা যাচ্ছে। ১. জীবনানন্দের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নয়, বরং ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি। ২. তার প্রপিতামহের নাম মহেন্দ্র কুমার  নয়, বরং বলরাম দাসগুপ্ত। ৩. জীবনানন্দের প্রপিতামহের তিন ছেলের নামের ক্ষেত্রে সোহরাব হোসেন জীবনানন্দের দাদা সর্বানন্দের নাম সঠিক লিখলেও বাকি দুজনের নাম ভুল লিখেছেন। বাকি দুই ছেলের নাম তারিনীচরণ দাশ ও ভোলানাথ দাশ।

প্রভাতকুমার দাস রচিত ‘জীবনানন্দ দাশ’ গ্রন্থটিকে যদি আমরা তার মূল জীবনীগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে সেখানে দেখা যাবে, জীবনানন্দের জন্মস্থান উল্লেখ করা হয়েছে বরিশাল শহর। শুধু তাই নয়, কীর্তনখোলাবিধৌত বরিশাল শহরের নৈসর্গিক পরিবেশের বর্ণনাও দিয়েছেন তিনি।

প্রভাতকুমার লিখেছেন,‘খালবিল নদীনালা বন বনানীঘেরা প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত জেলা শহরটির সঙ্গে দূরদূরান্তের গ্রামগুলির যোগাযোগ আঁকাবাঁকা পায়ে চলার পথ দিয়ে গাঁথা।…গাঁ-গৃহস্থবাড়ি গাছপালা শস্য ফসলঘেরা মনোরম পটে লেখা মফস্বল শহরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ (বঙ্গাব্দ ১৩০৫ ফাল্গুন ৬) শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ।’

এখানেই শেষ নয়। ‘জীবনানন্দ স্মৃতি ময়ুখ’-এ  (পৌষ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৬১-৬২) প্রকাশিত কোনো এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে লেখা একটি চিঠিতে স্বয়ং জীবনানন্দ লিখেছিলেন: ‘আমার জন্ম হয়েছিল বরিশালে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ফাল্গুন মাসে।’

জীবনানন্দের মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশ ‘উত্তরসূরী’ পত্রিকার ‘জীবনানন্দ স্মরণে’ সংখ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমার দাদা শ্রীযুক্ত জীবনানন্দ দাশ ১৩০৫ সালে ৬ ফাল্গুন বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন।’

আবু হাসান শাহরিয়ার সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ দাশ: মূল্যায়ন ও পাঠোদ্ধার’ বইতেও অশোকাননন্দ দাশ ‘জীবনানন্দের প্রাকৃতিক ও পারিবারিক পরিবেশ’ শিরোনামে যে নিবন্ধ লেখেন, সেখানেও ওই একই তথ্য রয়েছে যে, জীবনানন্দ দাশ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

যদিও ১৮ নাকি ১৭ ফেব্রুয়ারি তা নিয়েও বিভ্রান্তি ছিল। কিন্তু প্রভাতকুমার দাস লিখেছেন, তিনি নানাভাবে ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখটির ব্যাপারে সুনিশ্চিত হয়েছেন। আবার জন্মসাল হিসেবেও কেউ কেউ ১৮৯৮ লিখলেও ১৮৯৯-এর পক্ষে মত বেশি। কিন্তু জন্মস্থান হিসেবে বরিশালের সঙ্গে মোটাদাগে কোনো দ্বিমত নেই, যেটি ইদানীং কেউ কেউ পোষণের চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাদের এই বক্তব্যের কিংবা নতুন করে ইতিহাস নির্মাণের সপক্ষে কী তথ্যপ্রমাণ আছে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।

আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং আবুল হাসনাত সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থেও তার জন্মস্থান হিসেবে বরিশালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে আরও যেসব লেখক জীবনানন্দের জন্মবৃত্তান্ত লিখেছেন, তারা সবাই জন্মস্থান হিসেবে বরিশালের কথা উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে মার্কিন গবেষক ক্লিনটন বি সিলি তার ‘অনন্য জীবনানন্দ’ গ্রন্থেও তার জন্মস্থান হিসেবে বরিশালের কথা উল্লেখ করেছেন।

কারো কারো এরকম দ্বিধা হওয়া অসম্ভব নয় যে, জীবনানন্দ যখন জন্মেছেন তখন আলাদা করে ঝালকাঠি কোনো জেলা শহর ছিল না। বরং এটি ছিল বরিশালেরই অংশ। ফলে জীবনানন্দের জন্মস্থান হিসেবে বৃহত্তর অর্থে বরিশাল লেখা হলেও কার্যত তার জন্ম ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামেই। কিন্তু এই যুক্তিও ধোপে টেকে না যেখানে জীবনানন্দ নিজে এবং তার আপন ছোট ভাইও লিখেছেন তার জন্ম বরিশাল শহরে।

আকবর আলি খান তাঁর ‘চাবিকাঠির খোঁজে: নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন’ বইয়ের ৪৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশ এবং মা কুসুমকুমারী দাশ উভয়ই বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের পৈতৃক নিবাস বরিশালের বিখ্যাত গৈলা (আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়ন) গ্রামে। জীবনানন্দের মাতামহ চন্দ্রনাথ দাশ বরিশাল শহরের কালেক্টরিতে কাজ করতেন। ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করার পর তিনি পৈতৃক গ্রামে যাওয়া-আসা বন্ধ করে দেন। তাই পিতামহ বা মাতামহের গ্রামে যাওয়া-আসার সুযোগ জীবনানন্দের ছিল না। গ্রামের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল অতি ক্ষীণ।’

যারা বামনকাঠি গ্রামকে জীবনানন্দের নানাবাড়ি উল্লেখ করে সেখানে তার জন্ম বলে প্রচার করেন, সেই তথ্যও সঠিক নয়। কারণ জীবনানন্দের নানা বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামে। যদিও তার মা কুসুমকুমারীর জন্ম বরিশালে। মি. খানের ভাষ্যমতে, নানাবাড়িতে জীবনানন্দের জন্মগ্রহণের কোনো সুযোগ ছিল না।

ফলে সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, পিতৃ কিংবা মাতৃকুল––কোনো পক্ষের সাথেই ঝালকাঠি শহর বা তৎকালীন এই মহকুমার সাথে জীবনানন্দের পারিবারিক কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু যারা এখন তার জন্ম ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামে বলে দাবি করেন এবং প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তাদের দাবির সপক্ষে শক্ত কী তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, সেটি দেখার বিষয়। কিন্তু যে সত্যটি এত বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত, ১১৯ বছর পরে তা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক উস্কে দিয়ে আখেরে কী ফল  হবে, তা আন্দাজ করা কঠিন।

(লেখকের ব্যক্তিগত ব্লগ থেকে নেওয়া)